Sillery The Unknown Beauty

অচিন গ্রাম সিলারী

সময়টা ১৯৭০ এর আশেপাশে।

পেডং থেকে মাইল সাতেক দূরে, পাহাড়ের ঢাল বরাবর বিশাল এলাকা জুরে সিঙ্কোনা plantation এর  কাজ চলছে।  এই জনমানব হীন জঙ্গলে কাজ করতে এল ভবঘুরে চারটি পরিবার।বন দপ্তরের জমিতে দপ্তরেরই উদ্যগে পাহাড়ের উপরে এদের থাকার ব্যাবস্থা হল। শ্বাপদ সঙ্কুল গভীর জঙ্গল আর পর্বত প্রমান প্রতিকূলতা হল এদের সঙ্গী। ধীরে ধীরে চারটি পরিবার থেকে  ৩০টি পরিবার হয়ে সেই বসতি বর্তমানে আত্মপ্রকাশ করেছে একটা গ্রাম হিসাবে।নাম ‘সিলারী গাঁও’।আমাদের এবারের গন্তব্য। নিউ জলপাইগুড়ি  থেকে কালিঙপং।সেখান থেকে পেডং এর দিকে চলতে চলতে ২৫ কিমি.

দূরে,  পাহাড়ের উপরে এবড়োখেবড়ো পাথুরে রাস্তা দিয়ে আবার ৫ কিমি. গিয়ে যখন সিলারি পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় শেষ।বিকেলের আধো আলোতে সিলারী র পথের শোভা মনে দাগ কেটে যায়। মন ভরে দেখতে লাগলাম ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের ঘরে ফেরা,কাছে দূরে সবজে সবজে পাহাড় গুলোর হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকা।চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। বিশাল বিশাল পাইনের অতন্দ্র পাহারায় এই গ্রামে প্রবেশ করতে হয়।শেষ ৫ কিমি গাড়ির ঝাঁকুনিতে প্রান ওষ্ঠাগত হবার যোগাড়।যাইহোক গাড়ি থেকে নেমেই গরম গরম চা পেয়ে গেলাম। চা নিয়ে দাড়িয়ে আছে মান্যতা ভাবি মানে দিলিপ তামাং এর স্ত্রী। দিলিপজি র home stay তেই আমাদের দিন দুয়েকের থাকার ব্যাবস্থা। মন চাঙ্গা হয়ে গেল। পড়ন্ত বেলায় আমরা সবাই মিলে একটু হাঁটতে বেরলাম।হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেখলাম বিশাল বিশাল পাইনের জঙ্গলে এক চিলতে সবুজ তৃণভূমি। অসম্ভব শান্ত আর চুপচাপ।পাইনের গোড়ায় গোড়ায় জমাট বাঁধা মেঘ। এই জায়গাটার পোশাকি নাম নাকি ‘ valley of silence’। বেশ লাগলো জায়গাটা। চারদিকে সবুজে সবুজ। অনর্গল কিচিরমিচির, পাখিদের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। আর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ভেসে বেড়ানো। প্রথম দেখাতেই সিলারীকে ভালবেসে ফেললাম। সন্ধ্যায় খোলা বারান্দায় বসে গল্প জুড়লাম দিলিপজির সাথে। জানা গেল সিলারী নামে একপ্রকার বিরুৎ আশেপাশের জঙ্গলে প্রচুর পাওয়া যেত।এখানকার লোকজন সবজি হিসাবে খেত।এই শাক থেকেই এই গ্রামের নাম। গ্রামে কিছু বছর আগেও নাকি মাঝে মাঝেই চিতার আবির্ভাব হোতো। শুনলাম তাঁর নিজের চিতা দর্শনের ঘটনা। এরপর এল গান গাওয়ার পালা।দিলিপজি,ভাবি,ডোমা রাই,আঞ্জু ভাবি মানে রান্নায় যোগ দিতে আসা পাশেরবাড়ির ভদ্রমহিলা সবাই রান্না করতে করতে আসরে যোগ দিল। home stay তে আর কোন guest ছিলনা।তাই এই সন্ধ্যায় এই পাহাড়ি মানুষগুলো কে একেবারে তাদের মত করে পাওয়া গেল ।নেপালি আর বাংলা গানে আসর জমে উঠলো।কিছু গান আমরা বুঝলাম না আর কিছু গান ওরা বুঝল না। কিন্তু সবাই আনন্দ পেলাম।রাতে দেশী মুরগির ঝোল আর রুটি আর পরিপাটি করে  জম্পেশ ঘুম।                                                                                                               ভোরবেলা উঠে ছুটলাম ১ কিমি দূরে রামিতে view point কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখতে।অসম্ভব মেঘলা আবহাওয়া।সেই সাথে ঘন কুয়াশা। সূর্যদেব দেখা দিলেন না। কিন্তু প্রভাতের নরম আলোয় রুপোলি ফিতের মতো তিস্তা আমাদের রোমাঞ্চিত করে তুললো।পাহাড়ের ঢাল বরাবর লালচে সিঙ্কোনার চাষ  হচ্ছে।  চারদিকে সবুজ আর সবুজ। সে এক অদ্ভুত রঙের মেলা। একটু বেলায় আমরা ফিরে এলাম। ফেরার পথে দেখে এলাম গ্রামের একেবারে সোজাসুজি পাহাড়ের উপর  জঙ্গলের মধ্যে প্রকাণ্ড এক পাথর।নাম ‘ভালে ডোঙ্গা’।বাংলায় যার অর্থ হয় ‘মোরগ পাথর’। কেন এই নাম তা বোধহয় ঈশ্বরই জানেন।                                                                                    লুচি তরকারি দিয়ে break fast সেরে দিলিপজীর সাথে আবার চললাম ৩০০ বছরের পুরান লেপচা রাজার ড্যামস্যাং দূর্গ দেখতে।গ্রাম থেকে ২কিমি দূরে পাহাড়ের পিছন দিকে এই দূর্গ ঘিরে লেপচা আর ভুটিয়া রাজা দের বহু দিনের লড়াইের বহু গল্প শোনা যায়। তার দুয়েকটি পাওয়া গেল দিলিপজীর মুখ থেকে।ভুটিয়া রাজা লেপচা রাজাকে দুর্গের ভিতরেই নাকি কৌশলে হত্যা করেছিল। দূর্গের গোটা কতক পাঁচিল ছাড়া অবশ্য আর কিছুই পেলাম না। যেটা পেলাম তা হলো জঙ্গল কে অনুভব করার আনন্দ। বিশাল বিশাল মহীরুহ।উতিস,চাপ,সাহু কত রকমের স্থানীয় নাম তাদের। সাথে পাইন, রোডডেন্দ্রন আর প্রচুর জানা অজানা অর্কিড । আছে অসংখ্য ভেষজ গুল্ম যেগুলো গ্রামবাসীদের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। আর তারই মধ্যে নানান চেনা অচেনা পাখিদের অবিরাম কোলাহল। সত্যিই এক দারুন ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায়। দূর্গের একটা বিশেষ জায়গায় স্থানীয় এই বৌদ্ধ অধিবাসীরা প্রার্থনা করেন। দেখলাম বেদির উপরে প্রদীপ আর ধূপ রাখা।বেশ কিছু রঙ বেরঙ এর ফ্ল্যাগও রয়েছে। সামনের দিকে পাহাড়ের  খোলাপ্রান্ত থেকে পাখির চোখে দেখা যায় সবুজ উপত্যকার শোভা, পেদং এর সর্পিল পিচরাস্তা আর বিশমাইল জনপদ। এরপর চললাম তিনচুলের দিকে।  ড্যামস্যাং দূর্গ থেকে একঘন্টার রাস্তা।শেষ দিকে রাস্তা খুব চড়াই।৩৬০ ডিগ্রী view point.পরিষ্কার আবহাওয়ায় তিনচুলে থেকে যে View পাওয়া যায় এক কথায় তাকে অসাধারণ বলা চলে।কিন্তু আজ আকাশের মুখ ভার।আশেপাশে ভিজে ভিজে মেঘ।আমরা ফিরে এলাম।            দুপুরে খাওদাওয়ার সময় হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামলো। পাহাড়ে সবুজের মধ্যে বৃষ্টির মজাটাই অন্যরকম। বিকেলের দিকে বৃষ্টি থেমে গেল।সবুজ এখন যেন আরো সবুজ। মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে চারপাশ। সামনে মেঘ পেছনে মেঘ হাত বাড়ালেই মেঘ।আমরা দিলিপজীর সাথে গ্রাম দেখতে বেরোলাম। সিলারী তে বর্তমানে ৩০ টি পরিবারের বাস।বেশীরভাগই  তামাং পরিবার।তবে থাপা,মুখিয়া,রাই প্রভৃতি সম্প্রদায়ও আছে। প্রত্যেকটা বাড়িতেই উঠোনে নানান রঙের ফুল গাছ। মূলত চাষবাস যেমন এলাচ,আদা, রাই ইত্যাদি আর পশুপালনের উপরই সিলারী নির্ভর করত।২০০৯ নাগাদ  দিলিপ তামাং এর হাত ধরে এখানে পর্যটকদের আসাযাওয়া শুরু হয়।গ্রামের চার পাঁচটি পরিবার এখন  তাদের স্বাভাবিক জীবিকার পাশাপাশি home stay চালায়। কিন্তু গ্রামবাসীদের মানসিকতা এখনো নির্মলই রয়ে গেছে। উপরি পয়সার আনাগোনা তাদের মানবিকতাকে ছুঁতে পারেনি। পঞ্চাশের কোটার দিলিপ তামাং থেকে শুরু করে সদ্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চলা তরুণ সোরেন থাপাও তাই একসাথে বলে ফেলে ‘বেশি ট্যুরিষ্ট আমরা চাই না,তাতে আমাদের পরিবেশের বিপদ। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিপদ।আমাদের গ্রামের বিপদ।‘ হয়ত সত্যি। গ্রামে একজনের ঘর বানাতে এগিয়ে আসে আর এক জন। কারো বাড়িতে অতিথি এলে রান্নায় হাত লাগায় আশেপাশের অন্যান্য মহিলারা।তিন বছরের নিরজ তামাং দৌড়ে বেড়ায় গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত এবাড়ি থেকে ওবাড়ি কোনও গণ্ডি ছাড়াই। সবাই সবার বন্ধু, সবাই সবার আত্মীয়। নিজেদের মধ্যে এই মানবিক বাঁধনই সিলারির প্রতিটি মানুষের কাছে সঞ্জীবনী।                                                  গ্রামের ঠিক মাঝখানে  পাহাড়ের বুক ফুঁড়ে উঠে আসে ক্ষীণ জলধারা। এখানে বসবাসকারী সমস্ত প্রানের একমাত্র জলের উৎস। যেটা কোনও একসময় এলাকার জন্য যথেষ্ট ছিল কিন্তু এখন একালে ‘Tourist’ দের দৌলতে আর প্রয়োজন মেটে না। পেদং এর দিক থেকে বিদ্যুতের লাইন হবার কথা ছিল। Electric pole বসেছে, তা নাকি প্রায় বছর দেড়েক। কিন্তু আলো আর জ্বলেনি।দিলিপজীর কাছে শুনলাম সিকিমের নাকি ১০০% গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। অথচ পাশের পশ্চিম বাংলার এই গ্রামটিতে গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণের এই ভরা বাজারেও করুণ  অবস্থা কেন ভেবে পেলাম না।                                                                              গ্রামের পশ্চিমপ্রান্তে রয়েছে ড্যামস্যাং শিশুশিক্ষকেন্দ্র। যেখানে আছে একমাত্র শিক্ষক হাসিখুসি যুবক সৌরভ রাই আর ১২-১৩ টি ক্ষুদে পড়ুয়া। Class-IV এর পর ছেলেমেয়েদের যেতে হয় প্রায় ৯কিমি দূরে আলগড়া তে। যাতায়াত মূলত হেঁটেই। ইস্কুলের মাঠে বসে গল্প করতে করতে দিলিপজী বলে উঠলেন “কাল ভোরে উঠলে কাঞ্চজঙ্ঘা দেখে পাওয়া যাবে”।আমি অবাক হলাম। মনে হোল  আগামী কাল সকালে মেঘ থাকবে কিনা আজ বিকেলে বোঝা বোধহয় এঁদের পক্ষেই সম্ভব। এঁদের  যে আত্মীয়তা প্রকৃতির সাথে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমরা ফিরে এলাম। পরদিন সূর্য ওঠার আগে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে চোখ মেলে তাকাতেই আবছা আলোয় দেখতে পেলাম পূর্ব থেকে পশ্চিমদিক অবধি দিগন্তজোরা কাঞ্চনজঙ্ঘা তার সমস্ত পারিষদদের নিয়ে দাঁড়িয়ে। সিলারী থেকে কাব্রু সাউথ, কাব্রু নরথ,পানডিম,কুম্ভকর্ণ,ধবলগিরি এবং আর অনেক নাম না জানা তুষারাবৃত শৃঙ্গের সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার এই অসাধারন দৃশ্য দেখতেই তো আমাদের ছুটে আসা। একটু পরেই যখন এক বিশেষ দৈবক্ষণে সূর্যদেবের আলতো ছোঁয়া লাগলো গিরিকাঞ্চনে,রুপলি চূড়া তখন সিদুরে মাখামাখি। দুচোখ ভরে দেখলাম উপরে নীল আকাশ আর নিচে ঘন সবুজের মধ্যে গিরিরাজের সেই অপরূপ রংমিলন্তি। আবার আমরা রামিতে view point ছুটলাম। পাখির চোখে দেখলাম মোহোময়ী তিস্তা আর সামনে দিগন্তব্যাপী গিরিশৃঙ্গ। প্রকৃতির এই আশ্চর্য রূপ হয়তো কোনও দিন ভুলতে পারব না। মনটা কেমন করে উঠলো। ছুটি র ছুটি।এবার বাড়ি ফেরার পালা। ……………………………………………………

যাওয়া থাকা জানা

িয়ালদা,হাওড়া থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি।তারপর পানি ট্যাঙ্কির মোড় থেকে কালিংপং এর শেয়ার জীপ। সেখান থেকে গাড়িভাড়া করে নেওয়াই ভাল। নইলে শেয়ার জীপে পেডং এর কিছুটা আগে থেকে 4 কিমি মতো হাঁটতে হবে। যোগাযোগ করুণ দিলিপ তামাং এর সাথে 9635005318 (গাড়ির ব্যাবস্থাও করে দেন।)

সিলারী তে বিদ্যুৎ নেই তবে সন্ধ্যায়  জেনারেটর এর আলো পাওয়া যায়।জলের সংকট তবুও এখানকার মানুষ ‘tourist’ দের কোন অসুবিধা হতে দেয় না,তাইবলে অপচয় করা ঠিক নয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধপত্র সঙ্গে রাখা ভাল। কোনকারনেই পাহাড়ে নোংরা করা উচিৎ নয়।

Written on April 7, 2013